বর্তমান যুগে সংবাদ মাধ্যমের কারনে রীট শব্দটি বহুল প্রচলিত। শুধু তাই নয়, আইনি প্রতিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়ও বটে। আমি মনে করি অনুচ্ছেদ ১০২ বাংলাদেশের সংবিধানের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের তৃতীয়ভাগে অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে অনুচ্ছেদ ৪৩ পর্যন্ত মৌলিক অধিকার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদগুলোতে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমাবেশের অধিকার, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, গ্রেফতার বা আটক সর্ম্পকে রক্ষাকবচ ইত্যাদি অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মৌলিক অধিকার হল রাষ্ট্র প্রদত্ত এমন এক অধিকার যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অপরিহার্য বিষয়। এক কথায় বলতে গেলে মৌলিক অধিকার ব্যতিত সভ্য জীবন-যাপন সম্ভব নয়। এই অধিকারগুলো থেকে দেশের কোন নাগরিককে আইন বহির্ভূতভাবে বঞ্চিত করলে সে আইনের আশ্রয় নিতে পারে অর্থাৎ একজন নাগরিক তার মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য রীট আবেদন করতে পারে। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ দ্বারা দেশের জনগনকে তার মৌলিক অধিকার বলবৎ করনের জন্য আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হল।
সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে তার মৌলিক অধিকার বলবৎকরনের জন্য যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত নির্দেশনা বা আদেশ দান করতে পারেন। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের উদার ও ইতিবাক দৃষ্টিভঙ্গির কারনে “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি”-এর অর্থে ব্যপকতা এসেছে অথাৎ রীট মামলা দায়েরের যোগ্যতা বা Locus Standi-এর পরিধি ব্যপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে এখন শুধু নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি নন বরং দেশের যে কন জাতি, গোষ্ঠী বা জনগনের পক্ষ থেকে যে কেউ জনগনের স্বার্থে রীট মামলা দায়েরের অধিকার লাভ করেছেন, যাকে সহজ ভাষায় আমরা বলি জনস্বার্থ সংক্রান্ত রীট মামলা। ডঃ মহিউদ্দিন ফারুক (BELA-এর প্রতিষ্ঠাতা) মামলাটি জনস্বর্থ সংক্রন্ত রীট মামলার ক্ষেত্র এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এখন এ ধরনের মামলার সংখ্যা আর হাতে গোনা নয় বরং এর ব্যপকতা অবাক করার মত। আর এর কারন হল এখন আর ব্যক্তি পর্যায়ে নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেও জনস্বার্থে রীট হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষা বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনের জন্য বা সরকারের কোন পলিসির বিরুদ্ধেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জনস্বার্থমূলক রীট মামলা দায়ের হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও, মানবাধিকার সংগঠন, আইনী সহায়তা প্রতিষ্ঠান জনগনের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রীট মামলা দায়ের করেছেন। যার দ্বারা ব্যক্তি, জাতি, দেশ দারুনভাবে উপকৃত হচ্ছেন। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (BELA) এর জনস্বার্থমূলক রীট মামলা এবং তৎপ্রেক্ষীতে মহামান্য আদালতের রায় ও আদেশের কারনে দেশের প্রকৃতিক পরিবেশ অনেকাংশে সংরক্ষিত হয়েছে। সমাজের যেসব স্তরের মানুষ আদালতে আসতে পারেন না বা আসতে আগ্রহী হন না তারাও সমষ্টিগতভাবে এর সুফল ভোগ করছেন। আর এ সবই সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারনে। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছেন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহন করছেন। আদালতের এই বিশেষ ভূমিকা রাষ্ট্রের শাষণ ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং রাষ্ট্রীয় শাষণযন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা সরাসরি বাধার সম্মূখীন হচ্ছে। গতানুগতিক দীর্ঘসূত্রিতার মামলার বিপরীতে রীট মামলায় সংক্ষিপ্ত সময়ে কার্যকরী প্রতিকার পাওয়ায় এর ব্যপক বিস্তৃতি ঘটেছে তবে মনে রাখতে হবে তা কেবল মৌলিক অধিকার বলবৎ করনের ক্ষেত্রেই দায়ের করা যায়। আবার সব ক্ষেত্রে রীট মামলা দায়ের করা যায়না। যেখানে বিকল্প কার্যকরী কোন প্রতিকার বিদ্যমান সেখানে রীট মামলা অচল।
সংবিধান হল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন আর এই আইনের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের। তাদের আইনী ব্যাখ্যায় গণমানুষের কাছে রীট মামলা আরও সহজলভ্য হবে এবং তদানুযায়ী তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। কারন মানুষের জন্যই আইন, কিন্তু আইনের জন্য মানুষ নয়।
মোঃ আহসান হাবীব
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
মোবাইল: ০১৮১৮৫০৫১৪০